ধারাবাহিক- জন্মসূত্র (৪)

(সমাজের প্রান্তবর্গীয় দলিত সম্প্রদায়— রুইদাসদের (চর্মকার-মুচি) নিভৃত জীবনদর্শনের চিত্রপট )

জন্মসূত্র
-সুব্রত হালদার

 

 

[ সাত ]


রুইদাস পাড়ার পাশেই পৌন্ড্রক্ষত্রিয় পাড়া। পোদ পাড়া বললে এক ডাকে সবাই চেনে। আটচালার মিটিংয়ে সেই পোদ পাড়ার বাদল এসেছে। সঙ্গে দুলাল বলে একজন। দুলাল কিন্তু পোদ নয়। ও মুচি-রুইদাস। ওর বাড়ি সেই উস্তির পদ্মপুকুরের দিকে। বাদলের সঙ্গে দুলালের বন্ধুত্ব সবার জানা। ওদের দু’জনের আলাপ, হাইওয়েতে ট্রাক চালানোর সুবাদে। দু’জনেই ট্রাক ড্রাইভার। আর বিদেশ বিভুঁইয়ে বিপদ আপদ ঘটলে মানুষ এলাকার কাউকে কাছে পেলে আঁকড়ে ধরতে চায়। অচেনা হলেও। দু’জনে বাঙালী তো? আর খুব কাছাকাছি না হলেও মোটামুটি এলাকার লোক তখন কত আপন হয়ে যায়। জাতপাতের বজ্জাতি এই পাড়া এলাকাতেই জমাট বাঁধে। বাইরে সেসবের কোন গুরুত্ব নেই। সেখানে এক ভাষাভাষী এলাকার মানুষ এই পরিচয়ই যথেষ্ট। এমনকি ভিন্ন ধর্মের হলেও কোন ফারাক পড়ে না।
রুইদাস পাড়ার লতায়পাতায় কারোর সঙ্গে দুলালের আত্মীয়তাসূত্রে বাঁধন নেই। ওই বাদলের বাড়ি আসা যাওয়া করতে করতে পরেশের সঙ্গে দুলালের আলাপ। ঘনিষ্ঠতাও জমে ওঠে। বাদলের এখানে দুলাল আসলেই পরেশের বাড়ি আড্ডা দিতে সে আসবেই। জাতভাইয়ের একটা যে টান তা অস্বীকার করবে কে। সেইসঙ্গে দোসর যৌবনের উচ্ছ্বাসে টগবগ করা পরেশের বউ! এ টান কি আর প্রকাশ্যে গলা উঁচিয়ে বলা যায়? যায় না। এ টান অন্তর্সলীলে বয়ে যায়। পরেশের সঙ্গে আলাপের পর থেকে দুলালের এ’পাড়ায় আসার বহরও বেড়ে যায়। তাতে অবশ্য কারোর কিছু বলার নেই। বাড়ির বউ-মরদ দু’লোকে যখন কেউ কিছু বলে না, তা পাড়ার লোক আগ বাড়িয়ে ঝগড়া কিনতে যাবে কেন। তবে এ নিয়ে কানাঘুষো চর্চা যে চলে না তা নয়। সব জায়গায় পাড়া কালচার বলে একটা কথা আছে। সেই পাড়া কালচারে এসব নিয়ে জল-গুলুনি তো চলতেই থাকবে। বাদলও আসে দুলালের সঙ্গে। তিনজনের আড্ডাটা এখানেই বেশি জমে। এমন মধুর চিত্রপটে হঠাৎ কি করে যে কি হয়ে গেল। দুলাল কিছুতেই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেনি। পরেশের জেল হয়ে যাবার পর কোন মুখে আর সে ওবাড়িতে আড্ডা দিতে যাবে? চারিদিকে তাহলে ঢি ঢি পড়ে যাবে। এমনকি পরকিয়া প্রেমের অপরাধ তার ঘাড়ে চাপিয়ে শাস্তির মধ্যেও পড়তে হতে পারে। পরেশের জেলযাত্রার পর কয়েকবার বাদলের বাড়ি এসেছে দুলাল। পরেশ-বৌদির খোঁজ খবরও নিয়েছে। কিন্তু এদিন এসে যখন শুনলো আটচালার বিচারে ওদের গ্রামছাড়া করা হয়েছে, দুলাল সঙ্গে সঙ্গে খেপে আগুন হয়ে যায়! বাদলকে বলে, “এ কেমন বিচার গো তোমাদের ওপাড়ার রুইদাসদের? যে অন্যায় করল, তার তো চরম শাস্তি আইন দিয়েছে। তা নিরাপরাধ ওই মেয়েটা আর শিশুটা কি অন্যায় করল? এ কাজটা ওদের আটচালার করা ঠিক হয়নি। একটা অন্যায়ের শাস্তি দিতে দিয়ে আর একটা বড় অন্যায় ওরা করে ফেললো? গ্রামের একটা লোকও ওই অসহায় মেয়েটার পক্ষ নিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করল না! আমাদের পাড়াতেও তোমাদের আটচালার মত সরকারি বড় দালানঘর আছে। পাড়ার যাবতীয় মিটিং-টিটিং ওখানে হয়। বিচার-শালিশিও বসে। তবে এমন অমানবিক আর একতরফা বিচার মাতব্বররা কেউ কোনদিন করতে পারে না। ভুল হলেই অন্যরা চেপে ধরবে। মাতব্বরদের তড়পানির ভয়ে কেউ সিঁটিয়ে থাকে না। শুনলাম আজ সেই পরেশকে জড়িয়েই তো তোমাদের আটচালায় মিটিং আছে। আমি যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর আগে ওদের মাতব্বরদের দিতে হবে, তার পর ছুরি ব্যবহারের বিষয়ে কি নীতি নেবে তা নেবে। ও ব্যাপারে আমার কোন কথা নেই। তবে এই নিত্যসঙ্গী ছুরি ব্যবহারে একটা সঠিক নিয়ম মেনে চলা উচিত।”
দুলালের কথায় সায় দিয়ে বাদল বলল, “দেখো দুলাল, তোমাদের ওই রুইদাসদের কালচারের সঙ্গে আমাদের কালচার একদম মেলে না। আমরা, নস্কররা এই রুইদাসদের কোন ব্যাপারে মাথা গলাই না। এমনিতে ওরা ভীষণ হুটকো। দিনরাত সময় পেলেই মদ খেয়ে চুর হয়ে থাকে আর মতের অমিল হলে মারপিট, গালিগালাজ এদের মধ্যে লেগেই আছে। কোন ভদ্রলোক এই পাড়া দিয়ে যেতে সায় দেয় না। যারা এদের কথা জানে না, তাদের তো কিছু করার নেই। ওদের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হবার সুযোগ তখন তাদের হয়ে যায়। অবশ্য তাই বলে সবাই মাতলামো, গালাগালি, মারপিট-প্রিয় তা নয়। আজকাল কেউ কেউ বাইরে কাজে যেতে শিখেছে। সেই পরিবেশ আর এখানকার দমবন্ধ করা পরিবেশ তারা আলাদাভাবে বুঝতে শিখেছে। তারা চেষ্টা করে সমাজটাকে একটু ভদ্র জায়গায় নিয়ে যেতে। কিন্তু সময় লাগবে। যতক্ষণ না এদের মধ্যে শিক্ষার আলো প্রবেশ করছে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো মুশকিল। তাই একদম লাগোয়া পাড়া, আমাদের নস্কর পাড়া হলে কি হবে, এই মুচিদের ব্যাপারে আমাদের কিচ্ছু বলার বা করার নেই। হ্যাঁ আমাদের পোদ পাড়া যে শিক্ষা দীক্ষায় টৈটুম্বুর তা কিন্তু নয়। বরং গরিব এবং অশিক্ষিতই বেশি। তবে এদের মতো অবুঝ নয়। এদের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে আমরা কোনদিন পার পাইনি। পাড়া ঝেঁটিয়ে ওরা আমাদের দিকে তেড়ে আসতে কসুর করে না। তাই আমরা এদের কোন ব্যাপারে মুখ লাগাই না। তুমি ওদের জাতভাই আছো। তোমার কথা ওরা হয়তো শুনতে পারে। তবে এরা যা হেঁকাতে, মানবে বলে তো মনে হয় না।”

নন্দ-রতনরা, দুলালকে ভাল করে চেনে। নন্দর পিসির মেয়ের দুলালদের পদ্মপুকুরেই বিয়ে হয়েছে। তাই ওদের পাড়ায় ওর যাতায়াত আছে। একটা সময় ঘনঘনই যেত। ইদানিং কাজের চাপে আর তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। তাছাড়া অনেকদিন থেকে পরেশের বাড়িতে আসা যাওয়ার সুবাদে পাড়ার সকলেই দুলালকে চেনে। আরও ভাল করে চেনে, পরেশের যুবতী বউকে নিয়ে ওর সম্বন্ধে নানান টক-ঝাল-মিষ্টি আলোচনা-মস্করার সুবাদে।
সব কাজ কর্ম সেরে সন্ধ্যে আটটার মধ্যে পাড়ার সকলকে আটচালায় আসতে বলা হয়েছে। দুলালকে মিটিংয়ে আসতে দেখে নন্দরা একটু থমকে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে বলল, “আরে দুলাল ভাই। তুমি কবে এলে বাদলের বাড়িতে। তাও হঠাৎ আবার আমাদের আটচালার মিটিংয়ে? তা এসে যখন পড়েছো, তখন দেখে যাও আমাদের আলোচনা সভা। আমরা কেমন বিচার আচার করি, বিধান দিই। আমাদের বিচারের নিয়মকানুন তুমি জানতে পারবে। সেই অভিজ্ঞতা তুমি তোমাদের দালান বাড়ির সভায় কাজে লাগাতে পারবে।”
ততক্ষণে পাড়ার সবাই একে একে হাজির হয়ে গেছে। রতন বলল, “আমরা আজ কি জন্যে আটচালা ডেকেছি তা তো সবার জানা। এ’ব্যাপারে কারোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। আমরা আগে কে কি বলতে চায় শুনে নিই। তারপর আরও আলোচনা না হয় করা যাবে।” রতনের কথা শেষ হতে না হতেই দুলাল বলল, “আজকের যে তোমাদের আটচালা বসছে, তা জেনেই আমি এসেছি। কি বিষয় নিয়ে আলোচনা তাও আমার জানা। এই ব্যাপারে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে এই আটচালার উদ্দেশ্যে আমার কিছু জরুরী প্রশ্ন বলো, বক্তব্য বলো, আছে। মূল আলোচনার আগে আমার কথাগুলো শোনার অনুরোধ জানাচ্ছি। তার পরেই আমি চলে যাবো। তোমাদের নিজস্ব আলোচনায় আমি বাইরের লোক, থাকতে চাই না।”
দুলালের কথা শুনে আটচালা গুনগুন আওয়াজে ভরে উঠল। কেউ বুঝতে পারছে না, দুলাল এখানে ঠিক কি বলতে এসেছে। পাড়ার মাতব্বররাও ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা সেরে নিতে ব্যস্ত। হতেই পারে তাদের স্বজাতি কিন্তু অন্য গ্রামের লোক। তার বক্তব্য এখানে রাখতে দেওয়া হবে কি না সেই নিয়ে আলোচনা। শেষমেষ মাতব্বররা রাজি হয়ে গেল। নন্দ বলল, “বলো দুলাল, তুমি কি বলতে চাইছো। তোমার কথা শোনার পর আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরবো।”
কিছু সময়ের জন্যে সভা একদম স্থির। পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন। এবার দুলাল কোন ভূমিকা না করে সরাসরি সভাকে আক্রমণ করে বলল, “একজন নিরাপরাধ যুবতী-মা আর একটা দুধের শিশু, তারা কি অন্যায় করল যে তাদের জোর করে গ্রামছাড়া করা হল? অপরাধ যে করেছে সে তো শাস্তি পেয়েছে। একই অপরাধে দু’বার শাস্তি! প্রশাসন পরেশকে জেল-জরিমানা করে শাস্তি দিল। আবার তার পাড়ার আটচালা সেই পরেশকে শাস্তি দিল তার বউ বাচ্চাকে গ্রামছাড়া করে! এটা তোমরা কি বিচার করলে? তোমরা একবার ভেবে দেখলে না, তাড়িয়ে দিলে একটা মেয়ে তার বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাবে? সে তো তোমাদের পাড়ারই একজন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। পরেশ ভুলবশত একটা কাজ করে ফেলেছে। সে কাজটা ঠিক করেনি এটা মানছি। ও যদি এই ভুলটা না করত তাহলে তো পরেশ, ওর বউ-বাচ্চা সকলের চোখে তখন অন্য পড়শিদের মত আপনজন হত। এখন তো পাড়ার কেউ জানে না সেই মেয়েটা কোথায় আছে? কেমন আছে? নারীর মান-মর্যাদা নিয়ে সে টিকে আছে তো!”
দুলালের কথা শেষ হতেই সভায় হইচই শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ আবার দুলাল যে একেবারে বেঠিক কথা বলেনি সেটা বুঝে চুপচাপ থেকে গেল। তবে যারা সেদিন পরেশের বউকে গ্রামছাড়া করার জন্যে বেশি মাথাচাড়া দিয়েছিল, দুলালের কথায় তারা রে রে করে উঠল। মিত্তুনে চেঁচিয়ে উঠল, “পরেশের বউকে নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন রে? সে তোর সম্পর্কে কে হয় ? তোর তো দেখছি মা’র থেকে মাসির দরদ বেশি। তার সঙ্গে তোর কোন গোপন সম্পর্ক আছে না কি রে? খুব বুঝি রসিয়ে রসিয়ে ভোগ করা হচ্ছিল পরেশের বোয়ের যৌবন? ওই জন্যে পরেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ঘন ঘন তাদের বাড়িতে আসা হত। এখন তা আর হচ্ছে না বলে তোর গায়ে জ্বালা ধরছে, তাই না?” এবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই দুলাল লম্পটকে এক্ষুণি এখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক। পরেশের ব্যাপারে আমরা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটাই ঠিক। ও বিদেশ বিভুঁইয়ের লোক, ও আমাদের গ্রামের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে কেন? এক্ষুনি ওকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।”
তাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলতে মিত্তুনের উপর ‘খার’ বেড়ে যায় দুলালের, “আচ্ছা, আমি তো কথাটা মিত্তুনের বাড়িতে গিয়ে বলিনি। আর কাউকে দোষ দিয়ে বলিনি। এই সভা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তর উপর আমার মনের কথা বলিছি। তাতে মিত্তুনের অত গায়ে জ্বালা ধরল কেন? ওর এই জ্বালা ধরার পেছনে কারণ আছে। সবার সামনে আমার তা ফাঁস করার ইচ্ছে ছিল না। সেই কথা এ’পাড়ার কেউ কেউ জানেও। তা ও যখন আমাকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলে এতবড় অপমান করল তখন আমি আর চুপ করে থাকবো না। চলে তো আমি যাবই। এখানে থাকতে আসিনি। তবে ওর কেচ্চা না শুনিয়ে যাব না। সবাই জানুক, পরেশের বোয়ের উপর ওর কেন এত রাগ। পরেশ আমাকে সব গল্প করেছে। পরেশের সামনে থাকলে ও কেঁচো হয়ে থাকত। এখন সে নেই তাই এই হম্বিতম্বি।” দুলালের কথায় সভার নজর এবার গিয়ে পড়ল মিত্তুনের দিকে। যেন অপেক্ষা করতে লাগল, দুলালের কথার কাটান দিতে পাল্টা কি কথা মিত্তুনে বলে, তার জন্যে। কেননা দুলাল যদি প্রমাণ করতে পারে তো পরকীয়ার অপরাধে মিত্তুনের শাস্তি অবধারিত। গোপনে কে কি করছে ওই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু ধরা পড়লে বা প্রমাণিত হলে পরকীয়ার জন্যে কড়া শাস্তি দেয় আটচালা। সেটা মিত্তুনেও খুব ভাল করে জানে। তাই নিজেকে রক্ষা করতে সে দ্বিগুন চেল্লে উঠে বলে, “তুই আমার নামে কি ফাঁস করবি রে ‘গোহর’ বেটা? সাহস থাকে বলতো দেখি? আর বলতে না পারলে এ’পাড়ায় চিরদিনের মত তোর আসা বন্ধ হয়ে যাবে বলে দিলুম।”
দুলাল এবার আরও গলার স্বর চড়িয়ে বলল, “কেন পরেশের বউকে তুই বিপত্তারিনীর ডোর দিয়ে বলিসনি, এটা তুমি হাতে বেঁধে নিও। তোমার কোন বিপদ হবে না। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমরা গোপনে শীতলা টকীজে সিনেমা দেখতে যাব। আবার পরেশের বউ যখন ঘাটে চান করতে যায় সেই সময় তোরও চান করা পায়। পিট পিট করে হেসে তুই গিয়ে ঘাটের সামনে এসে দাঁড়াস। মেয়েরা ঘাটে চানে গেলে পুরুষরা কেউ যায়? যায় না। পরেশের বউ অনেকদিন তোকে বারণ করেছে। শুনিসনি। একদিন পরেশ আছোলা বাঁশের লাঠি নিয়ে তাড়া করতে তুই পাঁইপাঁই করে ছুট মেরেছিলিস। মনে আছে সেই কথা? এখন তো বলবি, সব মিথ্যে কথা। যেহেতু পরেশ এখন জেলে। আরও বাকি আছে। এটা তো সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ। তখনই পাড়ার কয়েকজন সেটা দেখে ফেলে। যারা দেখেছে তাদের অনেকে এখানে আছে। পাড়ার মায়েদের জনা দুই জানে। তাদের আমি নাম বলতে চাই না। পরেশ আমাকে ওর কীর্তির কথা গল্প করেছে তাই জানি। ভোরবেলা পরেশের বউ দক্ষিণমাঠে প্রাকৃতিক কাজ সারতে গিয়েছে। মেয়েরা তো লজ্জার মাথা খেয়ে আলো-অন্ধকারের ভোরে কাজ সারতে বাধ্য হয়। সেটা চৌকীতে থেকে ওই বেটা মিত্তুনে পরেশের বোয়ের পথ আটকায়। পরেশের বউ কোন উপায় না দেখে চেঁচাতে শুরু করে। সেসময় দূরে কাছে থাকা অন্য মেয়েরা চেল্লাচেল্লি করতে মাঠঘেঁষা বাড়ি থেকে লোক হাঁক পাড়তে ইজ্জৎ-চোরটা এক ছুটে পগার পার। পরেশ সেসময় ঘটনাটা আটচালায় তুলতে পারতো। কিন্তু এখানে নিজের বউকে নিয়ে ঘটনা। তাছাড়া ওই মিত্তুন বেটাকে তাহলে গ্রামছাড়া হতে হবে। তাই, তা না করে ওকে একদিন ডেকে পরেশ শেষবারের মত সাবধান করে দিয়েছিল। আর যেহেতু পাড়ার সামান্য দু’চারজন জেনেছে তাই ব্যাপারটা সবাই চেপে যেতে রাজি হয়। চোরের মা’র বড় গলা! আমাকে খেপিয়েছে। আমি ছেড়ে দেবো?”
দুলালের কথায় তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল মিত্তুনে, “তোকে শালা প্রমাণ দিতে হবে। নাহলে আমি তোকে ছাড়বো না। তুই আমাকে চিনিস না।” এবার মাতব্বররা মিত্তুনেকে থামতে বলল। রতন বলল, “দুলাল যে কেচ্চার কথা মিত্তুনের বিরুদ্ধে তুলল আর যাদের জড়িয়ে ব্যাপারটা, পাড়ায় তারা তো কেউ নেই। অতএব মিত্তুনের কেসটা আটচালার আড়কাঠে তোলা রইল। পরেশের বউ কোনদিন না কোনদিন তো গ্রামে ফিরবে। সেসময় কেসটা তোলা হবে। সে যদি অভিযোগ জানায়, তখন মিত্তুনেকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের বউকে শুধু ব্যাপারটা মুখ ফুটে বলতে হবে। কোন প্রমাণ দেবার দরকার নেই। তার মুখের কথাই সব। কেননা কোন মহিলা নিজের চরিত্রহনেন কথা পাঁচকান করে না যতক্ষণ না তা ঘটে। এতবড় অভিযোগ সবার সামনে তুলেছে দুলাল। এটা চাড্ডি কথা না।”
এবার দুলাল বলল, “আমার যে মূল বক্তব্য ছিল তার কি কোন উত্তর পাবো?” দুলালের কথায় রতন-নন্দদের পাশে বসা অন্য মাতব্বররা নিজেদের মধ্যে কিছু কথা চালাচালি করল। তারপর রতন বলল, “একটা বিশেষ যুক্তিতে সভা পরেশের বউকে গ্রামছাড়ার নিদান দিয়েছিল। তখনকার সিদ্ধান্তটা একদম ভুল তা আমরা মানছি না। দেখতে দেখতে তা বছর গড়িয়ে গেল। এখন মন হচ্ছে সেই শাস্তি তুলে নেওয়া যেতে পারে। তা পরেশের বউ যদি তার বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামে ফিরতে চায় ফিরতে পারে। আটচালা আর বাধা দেবে না।”
দুলাল-মদন মিটিংস্থল ছেড়ে চলে যেতে কিছুক্ষণ সব চুপচাপ হয়ে যায়। কিন্তু মিত্তুনকে, দুলালের ওপর রাগে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করতে দেখা যায়। ওকে কেউ আমল না দিয়ে রতনরা তাদের আজকের মূল বিষয়টা আলোচনার কথা তোলে। রুইদাস তথা মুচিদের জীবিকার মূল উপায় হল ভাগাড়ে পড়া গরুর চামড়া ছাড়িয়ে নানান পদক্ষেপের মাধ্যমে চামড়ার জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরী করা। সেই চামড়া ওরা মরা গরুর শরীর থেকে বার করতে যে ছুরি ব্যবহার করে সেটা তাদের কাছে লক্ষ্মী-পয়মন্তর। সেই জন্যে ওরা বাবা বিশ্বকর্মার কাছে সেই ছুরি সমর্পণ করে পুজো দেয়। আশীর্বাদ চায় যাতে সেই ছুরি সম্বচ্ছর সচল থাকে। এটা ওরা, মুচি-চর্মকার নির্বিশেষে মেনে চলে। এককথায় ওই অস্ত্র তারা ভগবানের কাছে নিবেদন করে থাকে। সেই ভগবান নিবেদিত বস্তুটাকে নিয়ে যদি কোন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে তা হবে নিতান্তই গর্হিত কাজ। এ কাজের কোন ক্ষমা নেই। এই কাজ করা মানে বাবা বিশ্বকর্মার সঙ্গে প্রতারণা করা। ভগবানের সঙ্গে যে প্রতারণাটা করল আমাদের ওই পরেশ রুইদাস। পরে হয়তো তার অনুশোচনা হয়েছে। কিন্তু তির একবার ছোড়া হয়ে গেলে তা আর ফেরত নেওয়া যায় না। ভুলের মাশুল তো তাকে গুনতেই হচ্ছে। মাতব্বরদের নির্দেশমত রতন কথাগুলো সভায় বলে গ্রামবাসীর এ বিষয়ে কারোর যদি আর কোন পরামর্শ বা বক্তব্য থাকে তা বলতে বলল। বিশু বলল, “বিপদের সময় নিজের জান বাঁচাতে হাতের কাছে যদি কিছু না পাই তো ঠাকুরের কাছে অচ্ছগ্য করা এই ছুরি তো আমরা ব্যবহার করতেই পারি। এতে তো কোন অন্যায় হওয়ার কথা না।” সঙ্গে সঙ্গে নন্দ বলল, “আলবাত অন্যায়। আমাদের কোমরে ছুরিটা সবসময় গোঁজা থাকে আমাদের রুজির কারণে। যাদের এই পেশা নেই তারাও কি আত্মরক্ষায় এমন অস্ত্র ট্যাঁকে গুঁজে রাখে? রাখে না। অন্য সব মানুষই তো অস্ত্র ছাড়াই চলে। আমরা কি এমন তালেবর হয়ে গেলাম যে সবসময় প্রাণ সংশয়ে কাটাতে হয় আমাদের? ওসব অজুহাত তুললে চলবে না। যে এই নির্দেশ মানবে না তাকে শাস্তি পেতে হবে। পরেশের থেকেও কঠিন শাস্তি পেতে হবে। আর তা দেবে এই আটাচালা।” রতন তখন নন্দর কথার রেশ ধরে বলল, “এই বিধিনিষেধ না মানা হলে আমাদের সমাজে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। দেখতে পাচ্ছি ইদানিংকালের ছেলেপুলেদের মধ্যে ধৈর্যের অভাব খুব। কাউকে সহ্য না হলে কথায় কথায় হাত তুলে বসে। এবার তাদের হাতে যদি এমন কোন অস্ত্র থাকে তো তারা সাতপাঁচ না ভেবেই সেই অস্ত্র ব্যবহার করে বসবে। ‘খুনি সমাজে’র তকমা মানুষ দেগে দেবে আমাদের সমাজটার উপর। এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সময় থাকতে রাশ টেনে ধরা দরকার।”
এমন বিস্তর আলোচনার মধ্যেই পরেশের হাতে খুন হওয়া রাধাকান্ত ঋষিদাসের ছেলে নিত্যানন্দর চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার খুনি, পরেশকাকুর স্বীকার করা কথাগুলো! কিভাবে তাদের দু’জনের ঝগড়া শুরু আর পরেশ তার পেটে ছুরি চালালো। নিত্যানন্দর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল। গামছার খোঁট দিয়ে তা শুষে নিয়ে সে বলল, “পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার সময় পরেশ কাকু মায়ের হাত ধরে বাবাকে খুন করার ঘটনার সবটাই কবুল করে বলেছিল, “সেইসময় ওদের দু’জনের মধ্যে ভয়ানক কথা কাটাকাটি চলছে। কেউ কাউকে রেয়াত করছে না। কেন যে নিত্যানন্দ তার উপর অতটা রেগে গেল তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। আসলে ও এমন নোংরা নোংরা গালাগাল তাকে দিচ্ছিল, সে মেজাজ ধরে রাখতে পারেনি।” কথা শেষ করতে দিল না পুলিশ। হেঁচকা টান দিয়ে প্রিজনভ্যানে তুলে নিল পরেশকাকুকে।”


[আট]


সময়টা পৌষ মাস। ভরভরন্ত শীত। প্রথম কাটের খেজুর গাছের রসের তখন স্বাদই আলাদা। ভোর পাঁচটার মধ্যে পরেশ রুইদাসের দাবায় লাইন পড়ে যায় তীব্র মিষ্টি স্বাদের সুগন্ধী খেজুর রস খাবার জন্যে। প্রতি গ্লাস দাম তিন টাকা। তাতেই পরেশ খুশি। এ’বছর আট আনা বাড়িয়েছে। নাহলে গত বছর আড়াই টাকা গ্লাস বেচেছে। এই ভিড়কে সামাল দিতে পরেশ তাই সূর্য ভোরের আলোর ফোকাস ফেলার আগেই হেঁসো নিয়ে বেরিয়ে যায় খেঁজুর গাছের রস নামানোর জন্যে। দিন শুরুর আগে এটা তার বাড়তি আয়। যদিও মরসুমী আয়। তাতে কি। সম্বচ্ছরের মাস তিনেক এই বাড়তি আয় বা আসে কোত্থেকে। এপাড়ায় আরও অনেকে পরেশের মত খেঁজুর রস বেচে। কেউ আবার রস তাওয়ায় ঢেলে তাতারসি বিক্রি করে, কেউ নলেন গুড়। যে যেটায় স্বচ্ছন্দ। তবে রস বিক্রি করতে গেলে ওই ভোর ভোর। সুর্য উঁকি মারলেই সেই সুস্বাদু রস থেকে গাঁজা বেরিয়ে তাড়ির বিটকেল গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আবার সেটা নেশার বস্তুতে পরিণত হয়। মাতাল যারা হতে চায় তাদের কাছে এই তাড়ির আকর্ষণ আলাদা। তবে পরেশদের মত এই খেঁজুর রসের শিউলিরা তাড়ি বানায় না। বউ ছেলে নিয়ে ঘর-সংসারে ওই মাতালদের আনাগোনা পরেশের একদম অপছন্দ। তাড়ির গন্ধ শুরু হবার লক্ষণ হলেই ও তাওয়ায় ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে নলেনগুড় বানিয়ে নেয়। রস থেকে গুড় তৈরী করে আবার তা বিক্রির জন্যে হাটে বাজারে নিয়ে যাওয়া বা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতে হয়। বড্ড সময় নষ্ট হয়ে যায়। পরেশের তাই একঝটকায় কাঁচা রস বিক্রি করাটাই বেশি পছন্দের। এই পছন্দের কাজ করতে গিয়ে তাই সে রোজ ভোর জেগে ওঠার আগেই শীতের ঘন কুয়াশা ভেদ করে বিড়ির মুখে আগুন ধরিয়ে খক্ খক্ করতে করতে চলে রসের ভাঁড় নামাতে। বারোখানা গাছ সে কাটে। এক দফে ছ’খানা তিন দিন পর দ্বিতীয় দফে ছ’খানা। খেঁজুর রস জোগাড়ের এটা নিয়ম, পরপর তিন দিন গাছের শরীরের মাস হেঁসো দিয়ে পাতলা করে কেটে সংগ্রহ করার পর তাকে জিরেন দিতে হয়। সেইসময় আর তার শরীরের আঁশ কাটা হবে না। আবার তিন দিন পর। এই তিন দিন জিরেনের পর চারদিনের মাথায় যখন প্রথম গাছে আঁশ কাটা হয় তাকে জিরেন কাটের রস বলা হয়। এই রসের স্বাদ বাকী দু’দিনের রসের থেকে অন্যরকম সুস্বাদু এবং তার নলেন গুড়ও সমানভাবে সুস্বাদু ও সুগন্ধী। এইভাবে বসে না থেকে পাল্টাপাল্টি করে গোটা শীত মরশুমটা কাজ চালাতে পারে।
সেদিন রাত-ভোরের কুয়াশা ভেদ করে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে পরেশ খেঁজুরের রস নিতে ব্যস্ত। চারটে গাছের রস ততক্ষণে একজায়গায় করা হয়ে গেছে। ভোর একটু একটু করে আড়মোড় ভেঙে জেগে উঠতে উদ্যত। হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে আসমানের আবছা আলোয় দেখতে পায় দৌলতপুরের চড়ার ধারের বটগাছের মাথায় তারা দল বেঁধে চক্কর মারছে। কেউ কেউ বটের মগডালে খানিক বিশ্রাম নিতে নিতে জমিনের দিকে ইতিউতি নজর ফেলে আবার উড়তে শুরু করেছে। ওরা যেন পরেশদের নিশান উড়িয়ে জানাচ্ছে, ভাগাড়ে খাবার এসে গেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসে তোমাদের খাবারটা নিয়ে যাও। তারপর আমরা আমাদের দায়িত্ব বুঝে নেব। তোমরা তোমাদের কাজ না সারলে আমরা দায়িত্ব বুঝে নিতে এগোতে পারছি না।
নিশানা দেখা মাত্র পরেশ খেঁজুর রস সংগ্রহের কাজে জলাঞ্জলী দিল। এতক্ষণের জোগাড় করা রসের বড় কলসিটা একটা খেঁজুর গাছে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে দিল। গাছ কাটার হেঁসোটা গাছের গায়ে কোপ মেরে সেঁটে বসিয়ে রেখে চুপিসাড়ে দে-দৌড়! একবারও ভাবার চেষ্টা করল না যে যারা রোজ ভোরে ওর কাছে খেঁজুরের রস খেতে আসে তারা অপেক্ষা করে আছে। ওর মুখ দেখার আশায় হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশায় থেকে থেকে একটা সময় হতাশ হয়ে পড়বে। এদিকে খদ্দেরদেরও চিন্তা বাড়তে থাকে পরেশকে নিয়ে। কোনকিছু বিপদ হ’ল নাকি পরেশের! রস পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে-টড়ে যায়নি তো? অথবা অন্য কোন বিপদ! এক এক জন এক এক রকম ভাবতে ভাবতে কেউ কেউ চলেও গেল। অন্য কারোর কাছে যদি খেজুর রস পাওয়া যায়। পাল পাড়ার পড়শী, নিতাই কিন্তু পরেশের দাওয়ায় বসে থেকে থেকে ভাবল পরেশ যে গাছগুলো থেকে রস পাড়ে সেখানে গিয়ে দেখলে কেমন হয়? যা ভাবনা তাই কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়ালো সেদিকে। নিতাই গিয়ে দেখে একটা খেঁজুর গাছের গায়ে বড় রসের ভাঁড়টা ঝুলছে। আর একটা খালি ভাঁড় তার গোড়ায় পড়ে। হেঁসোটা সেই গাছের গায়ে কোপ মেরে আটকে রাখা। অন্যকিছু ভাবার আগে মাতাল নিতাই আশপাশটা একবার দেখে নিল কাউকে দেখা যাচ্ছে কি না। কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে পাশেই একটা পেঁপে গাছ থেকে পেঁপের ডাগ কেটে তার ডগা থেকে পাতার দিকটা ছিঁড়ে সেই ডাগের নল রসভর্তি কলসিতে চুবিয়ে চোঁক চোঁক করে মনের সুখে পেট ভরে জিরেন কাটের রস খেয়ে নিল। রসে পেট মোটা করার পর মনে পড়ল পরেশের খোঁজের কথা। এই সব ফেলে কোথায় গেল বেটা মুচির বাচ্চা কে জানে! এ শালাদের কোন ভরসা নেই। কখন যে কোথায় পট করে হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চয়ই শালা ভাগাড়ে কোন গরু পড়ার গন্ধ পেয়েছে। এছাড়া আর কোথায় যাবে। অবশ্য জোর হাগা পেতেও পারে। তাড়ি খেয়ে খেয়ে পেট গরমে আমাশা বাঁধিয়েছে। তাই হাগার বেগ সামলাতে না পেরে মেরেছে ছুট। অনেকটা রস সে খেয়ে ফেলেছে। পরেশ ব্যাটা হেগে পেট খালি করে এসে যদি দেখে তার কলসির রস খোলে পড়ে আছে, তাহলে তাকে সন্দেহ করতে পারে। ও আসার আগে কেটে পড়াই ভাল। সেই চিন্তা করে নিতাই সেখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেউ যদি দেখে ফেলে তো তাকে সন্দেহ করতে পারে। পরেশ এসে রস চুরি গেছে বলে চেল্লাতে থাকলে সে তার নাম পরেশকে বলে দিতে পারে।
রাধাকান্ত ঋষিদাস দিঘিরপাড় বাজারে রাতে অমিত-মুদির দোকান মোনে। ও অমিত মুদির খুবই বিশ্বস্ত। তাই রাত্রে ওর হাতে অতবড় মুদি দোকানের সব ভার ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বাড়িতে বোয়ের পাশে ঘুমোতে পারে। বিনিময়ে রাধাকান্তর মাসের বেনে বাজারের প্রায় সব দায় নিয়ে নেয় অমিত-মুদি। এই তো প্রায় পঁচ বছর গড়াতে যায় রাধাকান্ত এইভাবে আছে। কেউ কোনদিন ওর বিরুদ্ধে কথা তোলেনি। অমিত-মুদিও তেমন খারাপ কিছু ওর মধ্যে দেখেনি।
ওই ভোরে রাধাকান্তর জোর পেচ্ছাপ পায়। পেচ্ছাপ করে ফিরতে গিয়ে নজর আটকায় সেই আকাশ-নিশানায়! সঙ্গে সঙ্গে ওর ঘুমন্ত তেজহীন শরীর চনমনিয়ে ওঠে! ঝিমিয়ে থাকা সারা শরীরের রক্তগুলো যেন চিলিক খেয়ে ঠেলা মারতে থাকে শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। বাজার তো তখন সুনসান। দোকান ছেড়ে যাওয়াটা কি তার ঠিক হবে? যদি চোরবেটা সুযোগ বুঝে কোপ মারার ধান্ধা করে! তখন তো তার সর্বনাশ, অমিত মুদির সাড়ে-সর্বনাশ। ওই চোরবেটাগুলো সব সময় তক্কে তক্কে থাকে। কারোর অসাবধানতার সুযোগ কাজে লাগাতে ওরা ওস্তাদ। সে এখন কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে দোকানে ঢুকে খিল-তাড়া মেরে চিৎ হয়ে শুয়ে কপালে দু’হাত ঠেকনা দিয়ে ভাবতে থাকে। খানিক পর বাঁ পাশ ফিরে হাতের কব্জিতে ঘাড় তুলে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। কোনদিকে চেয়ে আছে তা সে নিজেও জানে না। এভাবে আর কতক্ষণ থাকবে। ঘাড় কনকন করছে। আবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। তবু কিছুতেই যেন বুদ্ধিটা বার করতে পারছে না এখন সে কি করবে! হঠাৎ ধড়ফড় করে উঠে বসল। এবার আর সাতপাঁচ না ভেবে দোকানের বড়বড় দুটো তালা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। বাজারের রাস্তার এদিক ওদিক ভাল করে চোখপেড়ে দেখে নিল। সন্দেহের তেমন কিছু দেখতে পেল না। তাড়া লাগিয়ে তালা দুটোর একটা দরজার মাথায় লাগানো শেকলে আর একটা দরজার বালায় লাগিয়ে দিয়ে মারল ছুট! ছুটতে ছুটতে কোমরে হাত দিয়ে দেখে নিল জীবনসঙ্গী ছুরিটা আছে কি না।
পরেশের জিরেনকাটের খেজুর-রস চুরি করে খেয়ে ফিরতি পথে নিতাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রুইদাস পাড়ার দু’জনের সঙ্গে। ওরাও পরেশের ওখানে গিয়েছিল রস খাওয়ার জন্যে। না পেয়ে অন্য ঠেকে তাড়ি খেয়ে ফিরছিল। নিতাইকে দেখে বলল, “কিরে নিতাই, পরেশ এসেছে রস নিয়ে? এত বেলায় ওটা তো আর রস নেই। গেঁজলা উঠে তাড়ি হয়ে গেছে। আমরাও তাই খেলাম। তাড়ির নেশায় বেশ ভাল ঘোর লেগেছে রে। চুল্লুকে মনে হচ্ছে হার মানাবে।” ওদের কথার উত্তরে নিতাই, পরেশের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “হুঁ, কোথায় চুল্লু আর কোথায় তাড়ি। আকাশ আর পাতাল। তোরা তাহলে সেই চুল্লু কোনদিন গলায় সেঁধাস নি। আমার সঙ্গে একদিন যাস ননী-শুঁড়ির ঠেকে। বুঝতে পারবি নবাবী-চুল্লু কাকে বলে। তুই কে আর সিরাজদৌল্লা কে ফারাক করতে পারবি না। চলি রে। আর তোদের সঙ্গে গজালি করলে চলবে না। ওদিকে কাজে হাজিরা দিতে দেরি হয়ে যাবে। দেরি হলেই বড্ড খ্যাচর খ্যাচর করে ওই শালা মালিকটা।”
নিতাই চলে যেতেই ওদের দু’জনের, নোচে আর বিন্দের খেয়াল হল। নোচে বলল, “আরে, নেতাই শালা বলে গেল না তো পরেশ এসেছে কি না? তাহলে ওর কাছ থেকে দু’পাঁট তাড়ি খেয়ে যাওয়া যেত।” উত্তরে বিন্দে বলল, “চল না, রাস্তা থেকে তো পরেশের উঠোন দেখা যায়। ও বাড়ি ফিরলে দেখতে পাবো।”
না। তখনও শালা পরেশের দেখা নেই। বাড়ি ফেরেনি শালা। গেল কোথায় তবে? সেই ভোরে রস কাটতে গিয়ে কোথায় উধাও হ’ল বেটা? বিন্দে আওড়াতে লাগল। নোচে এবার থমকে দাঁড়াল! হয়েছে। বেরিয়ে এসেছে পরেশ উধাও হবার রহস্য। তোর চোখের দূরবীনটা ঘোরাতো বিন্দে সেই দৌলতপুরের চড়ার ধারে খেলার মাঠের বটগাছটার দিকে। কি নিশানা দিচ্ছে গাছ বেটা! চোখ তোর নেশায় ঘোলাটে হয়ে আছে। ভাল করে শক্ত হয়ে দূরবীনটা ফেল। তবে স্পষ্ট হবে।”
এবার বিন্দে তার ডান হাতটা নোচের ঘাড়ে চেপে ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “ওই দেখ, দেখ? আমি একা বললে তুই বলবি আমার চোখ ঘোলা। এবার তোর সাদা চোখে দেখ। ব্যাপারটা হচ্ছে কি ওদিকে!”
সঙ্গে সঙ্গে নোচে আর বিন্দে লুঙ্গী হাফ করে গুটিয়ে বেঁধে নেয়। কোমরে গোঁজা ছুরিটাকে আর একবার পেঁচিয়ে শক্ত করে আটকে টলমল পায়ে দৌড়ানোর ঢঙে এগোতে লাগল। ইটের হোঁচট খেয়ে, বিন্দে ঠাকুরের মানত করা দন্ডী কাটার মতো সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। টলমলে নোচে তার হাত ধরে উল্টোদিক দিয়ে টেনে তুলতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিন্দে গালাগাল দিয়ে বলে, “এই শালা গোহর বেটা। উল্টো দিক দিয়ে হাত ধরে টানছিস, আমার হাত তো খুলে যাবে দাবনা থেকে। লাগছে। ছাড় ছাড়। ভীষণ লাগছে! ততক্ষণে বিন্দের নেশা ছুটে গেছে। নেশামুক্ত বিন্দে বলে, “আমরা শালা এমন গাধির বাচ্চা সে আর কি বলব। শুধুমুধু ছুটতে গিয়ে আহত হলাম। পরেশ শালা কোন ভোরে ওই নিশান দেখে রস নামানো ফেলে ছুটেছে। এতক্ষণে তার গরুর ছাল ছাড়িয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির ফেরার সময় হয়ে গেল। একটু এগোলেই হয়তো আমাদের মুখোমুখি হবে সে। আর ওদিকে পা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাড়ি ফের। আটচালায় গিয়ে গজালি করি। কাজের কাজ হবে।”
কোমর সমান পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেয়াল দিয়ে গাঁথা আটচালা। সেটা প্লাস্টার করে মেঝে সমেত সিমেন্ট দিয়ে মাজা। আগে এসব ছিল না। কিন্তু এদিক ওদিক ঝোপঝাড় থেকে যখন তখন সাপ-বিছে বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে বর্ষাকালে। সাপের কামড় থেকে অনেকে অনেকবার বেঁচে গেছে মা মনসার কৃপায়। তারপর সিদ্ধান্ত হয় ওটা ঘিরে দেবার। নোচে-বিন্দে সেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দু’পা সামনে খেলিয়ে গজালি করতে করতে বিন্দেই কথাটা তোলে, “জানিস নোচে এবারে মিটিংয়ে এই ব্যাপারটা তুলতে হবে। যে শালা আগে নিশানা দেখবে গরুর চামড়া তার দখলে! আশ্চর্য! এটা একটা নিয়ম? এ তো কালা আইন। কে আগে নিশান দেখল, তা সাব্যস্ত করবে কে? দু’টো লোক যদি দু’ জায়গা থেকে দেখে? বুঝবে কি করে কে আগে দেখেছে? অনেক দিন থেকে এই নিয়ে গজগজ করছি। কোন শালা মাথা ঘামাচ্ছে না। যেদিন একটা বিশাল কেচাল হবে, সেদিন মাতব্বর শালাদের টনক নড়বে। তুই দেখবি, কেচাল একটা হবেই হবে। কেউ না বাধালে, আমি শালা নিজে বাধাব। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে আজ আমার খুব লেগেছে। তাও লাগাটা ভুলে যাওয়া যেত যদি চামড়াটা আমাদের দখলে আসতো। কিছুই হল না। শুকনো শুকনো ঝাড় খেতে হল।”
বিন্দের কথায় নোচের যেন কোন ‘গা’ নেই। তাড়ির নেশা তখনও তাকে জড়িয়ে রেখেছে। বিন্দে বকবক করছে আর নোচে কখন নেশার ঘুমে ঢলে পড়েছে। হঠাৎ বিন্দে লক্ষ্য করে নোচে বেটা নাক ডাকছে, “ধুর-শালা। কাকে রাম-নাম শোনাচ্ছি। এতক্ষণ তাহলে ভষ্মে ঘী ঢাললাম! হারামি-শালা নোচে কোথাকার! তুই শালা যখন ঘুমোচ্ছিস, আমিও বকর বকর করে শক্তি ক্ষয় করি কেন। আমিও গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যাই রাজকুমার-রাজকুমারীর পরীর দেশে! সুন্দরী সুন্দরী পরীদের সঙ্গে জলকেলি করি।”
মঙ্গলবার বড়বাজারে দোকানের মাল গস্তের দিন। তিরাশি রুটের ফার্স্ট বা সেকেন্ড বাসে করে যেতে হয় বাজারে। অমিত মুদি তাই এ’দিন সকালে আলো ফোটার আগে আগেই বাজারে চলে আসে। রাধাকান্তকে ঘুম থেকে তুলে বাজারের ঢাউস চারখানা ব্যাগ নিয়ে টাকা পয়সা ঠিকঠাক ট্যাঁকে সাইজ করে তৈরী থাকতে হবে, বাসের জন্যে। একটু দূরে রাস্তার ওপার থেকে দোকানের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে অমিত মুদির! দোকানে বাইরে থেকে বড় বড় দুটো তালা ঝুলছে! দোকানের দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাধাকান্ত কোথাও গেছে, না কি! না আদৌ সে গত রাত্রে শুতে আসেনি? ওঁ-হুঁ! তা তো হবার নয়। অমিত নিজে রাধাকান্তকে দোকানের ভেতর থেকে দরজায় খিল দেবার শব্দ শুনে তবে ঘরে গেছে। এটা একদম ভুল কথা না। তাহলে ও তালা ঝুলিয়ে গেল কোথায়? ও তো জানে আমি আজ গস্তে যাবো। সকাল সকাল দোকানে আসব। জেনেও এভাবে বেআক্কেলের মত চলে যাওয়া তো ঠিক করেনি! যাবে যদি বলতে পারতো। আমিই না হয় একটা রাত দোকানে কাটাতাম। এখন সময় বয়ে যাচ্ছে। ফার্স্ট বাস আসার সময় হয়ে গেল। ওটা যে ধরা যাবে না তা সে নিশ্চিত হয়ে গেল। কিন্তু সেকেন্ডটা না ধরতে পারলে তো আজ গস্তে যাওয়াই যাবে না। এটা সেটা অনেক মাল ফুরিয়ে গেছে। সারা সপ্তা তাহলে দোকান সে চালাবে কেমন করে? এ রকম ফ্যাসাদে তো সে কখনো পড়েনি। কি বিপদ দেখো দিকিনি! এখন সে কি করে? কোথায় গেল রাধাকান্ত বোকাচোদাটা! মুখ খারাপ কি এমনি এমনি আসে। ওদের আচরণে আসে। মুখ খারাপের কাজ করলে তো গালাগালি খেতেই হবে। রাগে গা গজগজ করছে তো কি করবে। কৃষ্ণনাম জপবে? তারা বৈষয়িক মানুষ। অত মহান এখনো হতে পারেনি। এসব সাতপাঁচ নিজের মধ্যে গজরাতে গজরাতে পাশে মোহনের সেলুন দোকানের দিকে এগোয়। মোহন ঘুম থেকে উঠে দোকান ঝাঁট দিয়ে ধূপধূনো দিচ্ছে। সেকেন্ড বাসটা আসতে এখনো আধঘন্টা দেরী। গোহরবেটা রাধাকান্তর জন্যে ততক্ষণে ওখানে বসে মোহনের সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে বলতে অপেক্ষা করবে আর কি।
ভাগাড় থেকে তখনো দশ-পনেরো ধ্বজি দূরে পরেশ। ঘন কুয়াশা ভেদ করে চোখে পড়ছে ছায়ার মত একটা মানুষের আকার নড়াচড়া করছে। একবার নীচু হয় আবার খাড়া হয়! আর একবার তাদের গ্রামের রাস্তার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে আবার যে কাজটা করছে সেদিকে মুখ ঘোরায়! চলকে ওঠে পরেশের বুকের রক্ত। ধকপক করে উঠছে ভেতরটা। লোকে বলে ওখানে নাকি মানুষের হৃদপিন্ড থাকে। হৃদপিন্ড মানুষকে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ চালিয়ে বাঁচতে সাহায্য করে। ওখানে চাপ পড়লে ও এইরকম ছটপট করতে থাকে। তাই এই ধকপকানিটা হচ্ছে। এসব ব্যাখ্যা পাশে সরিয়ে টানটান করে পরেশ এগিয়ে চলে ভাগাড়ের দিকে! অতসব ডাক্তারি কেতা জেনে তার কি লাভ? কোন্ শালা ওটা আগে তাকে দেখতে হবে। সে যখন নিশান দেখেছে তখন পৃথিবী পড়ন্ত রাতের ঘুমে মশগুল। কোনো ‘খানকির বেটার’ পক্ষে সম্ভব নয়, এই পরেশ রুইদাসের আগে নিশানটা দেখার।
রাধাকান্ত খুব ভাল করে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের পাড়ার দিক থেকে কেউ না কেউ আসবেই। শীতের মরশুমে এই ভোরের আলো-আঁধারে অনেকেই খেজুর-রস পাড়তে আসে। আর একটু পরেই বাহ্যে ফিরতে মাঠে ঘাটে সব বার হয়। খেঁজুর গাছে যারা উঠবে তারা সবথেকে আগে নিশান লক্ষ্য করতে পারবে। সেই হিসেবে কেউ না কেউ আসবেই। তাই মাঝে মাঝে ইতিউতি তাকায় আর গরুর ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!
হিসেব মত খেঁজুর গাছে চড়ে যে নিশান দেখতে পাবে সেই সবার আগে দেখবে। তাদের গ্রাম উজিয়ে এতটা পথ আসতে তো অনেকটা সময় কেটে যাবে। সেই তুলনায় বাজার থেকে ভাগাড়ের দূরত্ব গ্রামের রাস্তার তুলনায় সিকি ভাগ। পাড়ায় দাঁড়িয়ে যে দেখবে, বাজার থেকে তার অনেকটা পরে দেখেও পাড়ার থেকে আগে চলে যেতে পারবে। এই কম দূরত্বের সুযোগটা যে রাধাকান্ত নিয়েছে, তা সে খুব ভাল করে জানে। কিন্তু চামড়ার লোভ। যেন যুবতী বোয়ের যৌবনের প্রতি লালসার থেকে এই গরুর চামড়ার লালসা মুচিদের কাছে আরও অনেক বেশি। লাথি-ঝেঁটা মারলেও বউ সহজে হাতছাড়া হয় না। স্বামীর কাছেই মাথা গুঁজে টিকে থাকে। আর চামড়ার ক্ষেত্রে মুহূর্তের হিসেবের গরমিলে পুরোটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই রাধাকান্ত সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে বদ্ধপরিকর। কেউ তাকে আটকাতে এলে সে মিথ্যা কথাই বলবে, “সবার আগে সেই নিশানা দেখেছে। পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে ভোরের কুয়াশার আলো আঁধারিতে তার আগে কেউ নিশান দেখতে পারে না। কেননা, বাজার থেকে এই ভাগাড়টা অনেক কাছে। তাদের পাড়া থেকে এতটা দূরে তো দৃষ্টি পাতা যাবেই না। কুয়াশা সব আকাশকে গিলে বসে আছে।”
পরেশ ভাগাড়ের কানাচে আসতেই এতক্ষণের যত্তসব কুয়াশা যেন পগার পার! পরিস্কার দেখতে পেল তাদের পাড়ার রাধাকান্তকে? এই শুয়োরের বাচ্চা রাধে, তুই আমার আগে কোত্থেকে এলি? নিশান আমার আগে কেউ দেখবে, তা পারে না। আর তোর এতবড় সাহস, নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুই গরুর চামড়া ছাড়াতে শুরু করেছিস?”
পরেশের কথায় আমল না দিয়ে রাধাকান্ত যেন নির্বিকারে চামড়া ছাড়ানোর কাজটা করে যাচ্ছে। পেছন থেকে রাধাকান্তর পোঁদে সজোরে একটা লাথি কসালো পরেশ! মরা গরুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রাধাকান্ত। পড়ে গিয়ে রাধাকান্ত আহত তো হলই তার উপর ভয়ও পেল! কোনরকমে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ও ভাবতে লাগল, পরেশ এমন বদ মেজাজী তো কোনদিন ছিল না! আজ হঠাৎ এত মারমুখী হয়ে গেল কেমন করে? পাড়ায় কারোর সঙ্গে কোনদিন জোর গলায় কথা কাটাকাটি পর্যন্ত করেনি। অবাক হল ওর এই স্বভাববিরুদ্ধ রূপ দেখে। তবু চামড়ার লোভ মুচিদের মন থেকে যাবার নয়। মার খেয়ে ভয় পেলে ও তাকে আরও চেপে ধরবে। রুখে তাকে দাঁড়াতেই হবে।
পরেশ আবার রাধাকান্তকে লাথি কসিয়ে নিশ্চিন্ত রইল না। কিছুটা থমকে গিয়ে সেও জোর খাটিয়ে গরুটার অধিকার নেবার উদ্যোগ দেখাল না। ও অপেক্ষায় ছিল লাথ খাবার পর রাধাকান্তর দিক থেকে কি প্রত্যুত্তর আসে সেটা দেখার। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। দু’জনেই তো তাদের একান্ত পরিচিত পড়শি। সম্পর্ক তো কোন কারণেই দু’জনের মধ্যে তিক্ত হয়নি কোনদিন। বরং অনেক বেশি স্বাভাবিক। সেই দুই পক্ষ এখন মুখোমুখী। কাঠি-ঘা খাওয়া ক্ষিপ্ত সাপের মত মেজাজী ঢঙে রাধাকান্ত বলল, “তুই আমার পোঁদে অত জোর লাথি মারলি কেন? আমি কেন তোর কথায় উত্তর দিতে যাবো। আমি সবার আগে বটের মাথায় শকুন ওড়ার নিশান দেখেছি। দেখা মাত্রই ছুটে এসে আমার পাওনা গরু চামড়া আমার অধিকারে নিয়েছি। তুই কিছুতেই আমাকে এভাবে মারতে পারিস না। আটচালায় আমি এই অন্যায়ের বিচার চাইবো। তোকে পাড়া ছাড়া করে তবে ছাড়বো। আমার এই অপমানের শোধ আমি তুলবোই। আর এ গরুর চামড়া আমি কিছুতেই তোকে নিতে দেবো না। এটা আমার পাওনা, আমিই নেবো। কেউ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। আর তুই তো পরেশ রুইদাস। বেজন্মা জাত। তুই কোন্ ছার।”
জাত তুলে কথা বলতেই পরেশ আরও খেপে লাল হয়ে যায়, “হ্যাঁরে শালা। আমি বেজন্মা জাত। আর তুই কি জাত? তুই বেজন্মা থেকে আবার কবে মুচি হলি-রে শালা।” একটু থেমে পরক্ষণেই আবার পরেশ বলল, “তুই যে বললি শকুন ওড়ার নিশান দেখেই দৌড়ে চলে এসেছিস। হ্যাঁরে বোকাচোদা, বাজার থেকে এই ভাগাড়ে আসতে তড়কো পায়ে বড়জোর মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। এদিকে বলছিস পেচ্ছাপ ফিরতে গিয়ে নিশান দেখেই চলে এসেছিস। তাহলে তুই গরু ছোঁয়া থেকে বড়জোর পাঁচ মিনিট আগে নিশান দেখেছিস? আর আমাদের রুইদাস পাড়া থেকে এখানে আসতে বারো মিনিট লাগে। আমি এসে দেখলাম তুই সবে গরুর গায়ে খান দুই চ্যাঁ দিয়েছিস। তার জন্যে দু’মিনিট ধর। তাহলে ওদিকে পাঁচ আর এদিকে দুই। মোট সাত মিনিট তোর দিকে। আর আমার দিকে বারো মিনিট। এখন হিসেব কি বলে? তোর থেকে পাঁচ মিনিট আগে আমি নিশান দেখেছি। এবার তুই শালা অঙ্কে মেলা? কে আগে নিশান দেখেছে? কোন শালা অঙ্কবিদ এসে আমার হিসেবের ভুল ধরতে পারবে না রে শালা শুয়োরের বাচ্চা! মিথ্যে কথা অন্য মুচিকে দেখাবি। এই পরেশ রুইদাসকে দেখাতে আসবি না। এর পর তুই এখান থেকে না কাটলে তোকে আমি শেষ করে দেব বলে দিচ্ছি, রাধাকান্ত!”
-তুই ‘বাল্’কোন হরিদাস রে? তোর ভয়ে আমি কাটতে যাব? তোর ওসব অঙ্ক-ফঙ্ক আমি মানি না। আমি আগে নিশান দেখেছি, আগে এসেছি। এ গরুর অধিকার আমার। বলে রাধাকান্ত পাল্টা একটা ঠেলা পরেশের বুকে মারতে পরেশ উল্টে বসে পড়ে। তার সেই ঠেলায় রাধাকান্তর হাতে থাকা ছুরির আঁচড় পরেশের দাবনা থেকে কব্জি পর্যন্ত চিরে রক্ত বেরোতে থাকে! সঙ্গে সঙ্গে পরেশ তার কোমরে বাঁধা গামছাটা ক্ষতে বেড় দিয়ে চেপে বেঁধে দেয়। মাথায় খুন চেপে যায় পরেশের। দ্বিতীয়বার আর অন্য কোন কথা চিন্তা না করে পরেশ সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাধাকান্তর উপর! ট্যাঁকে গোঁজা গরু ছাড়ানো ছোরাটা চেপে বসিয়ে দেয় রাধাকান্তর পেটে। ছোরাটা বসিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি পরেশ। মৃত্যু নিশ্চিত করতে ছোরাটা দু’বার পেটের এপাশ ওপাশ চালিয়ে দেয়। গরু-ছাগলের চামড়া ছাড়ানো পোক্ত হাত নিখুঁতভাবে রাধাকান্তর শরীরে প্রয়োগ করে সে।
ভাগাড়ে এখন দুটো লাশ। একটা গরুর, একটা মানুষের। শকুনদের তো পোয়া বারো। একজন গরুর লাশে বসে তো অন্যজন রাধাকান্তর ভসকানো ভুঁড়ির উপর। ভাগ্য এতটা পয়মন্তর, ‘বিরল’ শকুনদের কাছে। অন্যদিনের থেকে আরও যেন বেশি বেশি শকুন আজ এখানে এসে হাজির হয়েছে। হয়তো ইতিমধ্যে জোড়া খাদ্য ভাগাড়ে পড়ার খবর ওদের মধ্যে চাউর হয়ে গেছে।
রাধাকান্ত বেয়নে অমিত মুদির বড়বাজারে গস্তে যাওয়া তো ডগে উঠল। কিন্তু এতটা বেলা হবার পরও তাকে আসতে না দেখে অমিতের মনে ‘কু’ ডাকতে শুরু করল। অত ভোরে কোথায় বার হল লোকটা! কতটা বেলা হয়ে গেল এখনো ফিরল না। ওর কোন ক্ষতি টতি হয়ে গেল না তো? সেলুন মালিক, মোহনকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কি করি বলতো মোহন। দৌলতপুরের ভাগাড়ের দিকে প্রচুর শকুন ওড়াউড়ি করছে। গরু তো নিশ্চয়ই পড়েছে। রাধাকান্ত সেখানে গিয়ে এতক্ষণে ওর ফিরে আসার কথা। ও তো গল্প করে, একটা গরুর চামড়া ছাড়াতে ওদের সামান্য সময় লাগে। তার উপর দোকানের চাবি তার কাছে। সেটা মাথায় রাখলে ওর তো এত দেরি করার কথা নয়!” মোহন পরামর্শ দিল, “তুমি একবার না হয় পা পা করে ভাগাড়ের দিকে যাও কাকা। ওইটুকু তো রাস্তা। এখানে বসে থেকে বেলা করে লাভ নেই। কোলকাতার গস্ত তো ডব্বায় গেল। এবার সারাদিন দোকান খোলাটাই না ডগে ওঠে। ওদিকে না গেলে বুঝতেও পারছো না, কি থেকে কি হচ্ছে। দরকার হলে এখন তোমার রুইদাস পাড়াতেও ছুটতে হতে পারে।”
মোহন নাপিতের পরামর্শ মত অমিত মুদি গুটি পায়ে ভাগাড়মুখো হয়।কিছুটা এগোবার পর পরেশ মুচির মুখোমুখি হয়। তার চেহারা দেখে তো অমিতের চোখ কপালে ওঠার জোগাড় ! এল্টে তোলা কাপড়ের ওপর পাতলা ‘বামুনে’ গামছা জড়ানো। বাঁ হাতের কব্জিতে মোটা করে কাপড় জড়ানো। বোঝাই যায় খোঁজুর রস কাটার হেঁসোর ধার বজায় রাখার জন্যে ঘষতে ঘষতে সাদা কাপড়ের সামনের দিকটা কেল্টে এন্দেকার হয়ে গেছে। এই শীতেও তার লোমঅলা বুকে জড়ানো স্যান্ডো সাদা গেঞ্জী রক্তে লাল হয়ে আছে। অবশ্য পরেশদের মত গাছে-চড়া লোকদের শরীরে এই হাল্কা শীত তেমন কামড় বসাতে পারে না। এল্টেতোলা কাপড়-গামছাও রক্তে ভিজে জবজবে! পরেশের এমন চেহারা দেখে একবার গা-টা গুলিয়ে ওঠে অমিতের! সঙ্গে সঙ্গে ওসব গরুর রক্ত হবে ভেবে নিয়ে নিজেকে সতেজ করে পরেশকে জিজ্ঞেস করে, “কি রে পরেশ, ভাগাড়ের ওদিক থেকে তো আসছিস। রাধাকান্তকে দেখলি? শালার বেটা শালা সেই ভোরে কখন আমার দোকানের চাবি নিয়ে ভেগেছে, এতটা বেলা হয়ে গেল, এখনো তার পাত্তা নেই? এত ক্যালাস লোক তো জীবনে দেখিনি?” সঙ্গে সঙ্গে পরেশ বলল, “দেখিছি। তুমি দেখো গে যাও। ভুঁড়ি ভসকে ভাগাড়ে মরা গরুর পাশে কেমন পড়ে আছে তোমার গান্ডু দোকান মুননদার, রাধাকান্ত ঋষিদাস!” কথাটা বলেই পরেশ নির্বিকারে নিজের পথ ধরল। অমিত পেছন ফিরে পরেশকে দেখে আর ঠায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে!

ক্রমশ….. 

Loading

Leave A Comment